গৌড় একসময় ছিল প্রাচীন বাংলার এক উন্নত জনপদ। কখনো বৌদ্ধ, কখনো হিন্দু, মুসলিম এবং সবশেষে ইংরেজদের শাসনে গৌড়-মালদহের নিজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শনে রঙিন হয়েছে অধুনা মালদা। মালদা যেন আস্ত একটা ভারতবর্ষ। বড়ো বড়ো মিনার, গম্বুজ, মসজিদ থেকে শুরু করে মন্দির, চার্চ – ইত্যাদি নিয়ে গৌড়-মালদহ-পাণ্ডুয়া ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে আজ এক বড়ো গন্তব্যের ঠিকানা।
গৌড়ে অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করে পাল বংশ। এরপর সেন রাজারা । এই বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময় গৌড়ের নাম হয় লক্ষ্মণাবতী। পরবর্তীকালে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লাকে হারিয়ে ইংরেজরা আধিপত্য কায়েম করে বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষে।তখন এর নাম হয় ইংরেজবাজার। এবার দেখে নেওয়া যাক গৌড়-মালদহের কিছু দর্শনীয় স্থান।
গৌড়
গৌড় মালদা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরেভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর মাঝে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার ইতিহাস বহনকারী বড়ো সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, কদম রসূল মসজিদের স্তাপত্যশৈলী দেখার মতো।
বারো দুয়ারি মসজিদ
গৌড় -এর স্মৃতিসৌধ গুলির মধ্যে বৃহত্তম হলো এই বারো দুয়ারি মসজিদ। ১৫২৬ সালে হুসেন শাহের পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরৎ শাহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হিন্দু ও আরবীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রনে তৈরি এই মসজিদটি বড়ো সোনা মসজিদ নামেও পরিচিত।
গুমতি দরওয়াজা
গুমতি দরওয়াজা ১৫১২ সালে তৈরি করেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। ইটের টেরাকোটা ও বিভিন্ন রঙের কারুকার্য করা এই স্থাপত্য আলাদা ভাবে নজর কাড়ে। কথিত আছে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই গুমতি দরওয়াজা। পরে সেসব অবশ্য অবলুপ্ত হয়েছে।
দাখিল দরওয়াজা
ছোটো ছোটো লাল ইট ও পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি টেরাকোটা কাজ করা দাখিল দরওয়াজা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ। ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ২১ মিটারের বেশি উঁচু ও প্রায় ৩৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই স্তম্ভটি সেলামি দরওয়াজা নামেও পরিচিত।
ফিরোজ মিনার
দাখিল দরওয়াজা থেকে ১ কিলোমিটার দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ তলার এই মিনার ১৪৮৫ থেকে ১৪৮৯ সালের মধ্যে তৈরি করেছিলেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। দিল্লির কুতুব মিনারের অনুরূপ ২৬ মিটার উচ্চতা ও ১৯ মিটার প্রস্থের ফিরোজ মিনার তুঘলকি ও টেরাকোটা কারুকার্য দ্বারা নির্মিত।
আদিনা মসজিদ
১৩৬৯ সালে সুলতান সিকান্দার শাহ নির্মিত আদিনা মসজিদকে ভারতের বৃহত্তম মসজিদ ধরা হয়ে থাকে। অষ্টম শতকে সিরিয়ার দামাস্কাসে তৈরি হওয়া এক মসজিদের আদলে এটি তৈরি হয়েছিল।
বল্লাল বাটি
গোলাকৃতি গঠনের মাঝে ছিদ্র বর্তমান এই অংশটি ২০০৩ সালে খনন করে পাওয়া গেছে। জনশ্রুতি মতে মাটির নীচে পাওয়া অংশটি সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেনা (বা বল্লাল সেনের) প্রাসাদের অবশিষ্ট অংশ। অন্য একটি মত অনুযায়ী বল্লাল বাটি সম্ভবত এটি কোনো বৌদ্ধ “বিহার” বা বিহারের অংশ বিশেষ।
আদিনা ডিয়ার পার্ক
আদিনা ডিয়ার পার্ক মালদা শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে গাজোল থানার মধ্যে অবস্থিত। ১৯৮২ সালে তৈরি এই ডিয়ার পার্ককে কেন্দ্রীয় সরকার একটা ছোটো চিড়িয়াখানা রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় ১০০ হেক্টরের ওপর জমিতে তৈরি সংরক্ষিত পার্কে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, পাখি, পরিযায়ী পাখি, নীল গাই এবং প্রচুর চিতল হরিণ দেখতে পাওয়া যাই।
এছাড়া বল্লাল বাটি (রাজা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ), ফতে খাঁয়ের সমাধি, লুকোচুরি গেট, চিকা মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ, লোটন মসজিদ, গুনমন্ত মসজিদ, চমকাটি মসজিদ, পাণ্ডুয়া দরগা শরীফ, একলাখি সমাধি, কুতুব শাহী বা সোনা মসজিদ, প্রভৃতি স্থান ঘুরে দেখা যেতে পারে।
এতো গেলো ঐতিহাসিক মালদা। মালদার ফজলি আম জগৎ বিখ্যাত। এছাড়া ল্যাংড়া, ক্ষীরপাই, বৃন্দাবনী, কৃষ্ণভোগ প্রভৃতি জাতের আম বিশেষভাবে সমাদৃত। আমের সময় এই আম বাগান পরিদর্শন করতে বহু মানুষ মালদা যান।
কীভাবে যাবেন ?
কলকাতা থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরের মালদা পৌঁছনোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ট্রেন। প্রচুর ট্রেন রয়েছে হাওড়া, শিয়ালদাহ, কলকাতা ও বিধান নগর স্টেশন থেকে। হাওড়া থেকে বালুরঘাট স্পেশাল (০৭.৫০ – ১৫.২৫), কুলিক স্পেশাল (০৮.৩৫-১৫.২৫), শতাব্দী এক্সপ্রেস (১৪.১৫ – ১৯.১০), সরাইঘাট এক্সপ্রেস (১৫.৫৫ – ২১.৩০), শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস (০৬.৩৫ – ১৩.১৫), তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস (১৪.০০ – ২২.০৫), হাটে বাজারে এক্সপ্রেস (২০.১০- ০৪.৩৫), দার্জিলিং মেল্ (২২.০৫ – ০৪.১৫), পদাতিক এক্সপ্রেস (২৩.২০ – ০৫.২৫). কলকাতা স্টেশন থেকে শিলঘাট টাউন কাজিরাঙা এক্সপ্রেস (০৯.০৫ – ১৫.০০), রাধিকাপুর এক্সপ্রেস (১৯.৩০ -০৩.২৫), এবং বিধান নগর স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস (১৭.৪৯ – ০২.৩০), কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস (২০.৪৪ – ০৩.০৫) ও গৌড় এক্সপ্রেস (২২.২৪ – ০৫.৫৫) । এছাড়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সরাসরি কলকাতা থেকে মালদা যাওয়া যায়।